গল্প #নেশার খেলা - মুহাম্মদ রমিজ উদ্দিন
গল্প #নেশার খেলা - মুহাম্মদ রমিজ উদ্দিন
সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরছিলাম। অন্ধকার তখন একটু একটু করে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল। মাগরিবের নামায পড়ে বের হয়ে বাড়ির পথ ধরে হাঁটছি। বশির চাচা দেখি চিল্লায় চিল্লায় কাকে যেন ফোন করছেন। গ্রামের মানুষ মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় একটু চিল্লায় চিল্লায় বলে, এটা স্বাভাবিক। তবে বশির চাচার কথায় অস্বাভাবিক কিছু শব্দ ছিল, যা শুনার পর আমার চলার গতি থেমে যায়। অামি থমকে দাঁড়ায়। চাচা, ফোনে বলছিল, "মানিক! 'রংপুর রাইডারস' আর 'খুলনা টাইটেন' খেলা আজ। দারুণ একটা খেলা হবে কিন্তু, খেলবি?" আমি অবাক হয়ে পেছনে তাকায়। 'রংপুর রাইডারস' আর 'খুলনা টাইটেনের' খেলায় মানিক ও বশির চাচা কিভাবে খেলবে?
খেলা তো ঢাকায়, এরা এখান থেকে খেলবে? আজব তো!
মোবাইল ফোনে বলা পরের শব্দগুলো যখন কানে আসে তখনই আক্কেলগুড়ুম হয়। ফোনের ওপাশ থেকে মানিক চাচা বলছিল, "পাঁচ পাঁচ"। বশির চাচা চিল্লায় বলে, "না, না তিন তিন" আমি পাঁচ পারবো না ভাই। ইদানীং আমার ইনকাম নাই। গত তিনটাতে মার খেয়েছি।
হুম, বুঝতে পেরেছি। এ তো সেই খেলা, যে খেলায় মত্ত হয়ে সর্বস্ব খোয়ানো হয়। কেউ ঘরবাড়ি ছাড়ে আর কেউ বউ বাচ্চা।
এশারের নামায পড়তে গিয়ে দেখি খলিল মিয়ার দোকানে হৈচৈ। খেলোয়াড়ের নাম ধরে একদল স্লোগান দিচ্ছে। আরেকদল গালে হাত দিয়ে বসে আছে। মানিক চাচাও গালে দিয়ে ফেলছেন। বশির চাচা তখন সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে আর 'সাবাশ মাহমুদুল্লাহ' 'সাবাশ' বলে বলে টেবিল চাপড়াচ্ছেন। অনেকে আবার ঢোল পেটানোর মতো করে টেবিলে তাবলা বাজাচ্ছে। কেউ কেউ টেবিলে থাকা পানির জগ নিয়ে ঢোলের সুর তুলছে । খলিল মিয়া জোর গলায় বলেন, "ভাই কে কি খাইছেন টাহা দিয়ে যান। আর চিল্লাচিল্লি বন্ধ করেন, মানুষ নামাযে যাচ্ছে।" কে শোনে কার কথা। সবাই জয়-পরাজয়ে মত্ত। অনেকে দাঁড়িয়ে গেছে। এটি দোকান নয়, যেন খেলার মাঠ। নামায শেষে ফেরার পথেও দেখি একই অবস্থা। সবচেয়ে অবাক হই খলিল মিয়ার কথা চিন্তা করে। এতো জমজমাট ব্যবসা ফেলে খলিল মিয়া নামাযে যেতে পারেনি আজ। অথচ নামায কাযা করার লোক নয় সে। আজ কাযা খেলার কারণে। কেন হবে না! খেলাকে ঘিরে তো ব্যবসা।
খলিল মিয়া আগে থেকে চায়ের দোকান করতো। স্ত্রী, পাঁচ ছেলেমেয়ের সংসার নিয়ে মোটামুটি চলছে। চায়ের দোকান করলেও লোকটি ভালো। আচার-আচরণ ও লেনদেনে সাতপাঁচ করে না। পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে গিয়ে আদায় করে। মাঝেমধ্যে তাবলীগের চিল্লায় যায়। আমাদের এলাকায় যে মসজিদ আছে তাতে দাওয়াতের মেহনত করে। নামাযের জন্য লোকদের কে হেদায়তের বাণি শোনায়। সেই খলিল মিয়াও দেখি ৩২ ইঞ্চি এল.ইডি নিয়ে আসলেন। না এনে উপায় আছে?
পাশের দোকানদার, আফতাব যে জমজমাট ব্যবসা করে যাচ্ছে তা কেবল টেলিভিশন দিয়ে। আফতাবের দোকান খলিল মিয়ার চেয়ে ছোট। কিন্তু খেলার দেখার জন্য লোকে ভীড় করে সেখানে। আর খলিল মিয়ার দোকানে মাছিও বসে না। এ নিয়ে বড়ই দুঃশ্চিন্তা তার। পাশের জনেরা সবাই তাড়া দিচ্ছে যেন দ্রত টেলিভিশন নিয়ে আসে। ব্যবসা করতে টিভি লাগে। চায়ের দোকান বলে কথা। টেলিভিশন ছাড়া কি চায়ের দোকান চলে?
এখন টেলিভিশন কোথায় পাবে? কেনার মতো টাকা তো নাই?
সেই দুঃচিন্তা থেকে মুক্তি দিল রবিন সাহেব। রবিন সাহেবও আমাদের এলাকার লোক। কোনো এক এনজিও সংস্থার বড় পদে চাকরি করে বলে সবাই সাব (সাহেব) ডাকে। রবিন তার এনজিও থেকে সাপ্তাহিক কিস্তিতে পরিশোধের শর্তে টেলিভিশন কিনে দিলেন। এনজিও সংস্থা খলিল মিয়াকে ক্যাশ টাকা দেয়নি বরং টেলিভিশন কিনে দিয়েছে। কাগজে সই করার আগে সুদের বিষয়টা ভালোভাবে বুঝিয়ে দেন রবিন সাহেব। সুদের কথা শোনে প্রথমে আঁতকে উঠে খলিল মিয়া। পরে আফতাবের ব্যবসার কথা মাথায় আসতেই রাজি হয়ে যায়। সানন্দে নিয়ে নেয়। সেই থেকে তার দোকানে জমজমাট। ভাটা পড়ছে আফতাবের দোকানে।
মানিক চাচা ও বশির চাচা দু'জনই আমাদের এলাকার। মানিক চাচা তো আগে থেকেই খাপছাড়া। বাবার টাকা পয়সা ছিল, ছিল জায়গা-জমি ও ব্যবসা-বাণিজ্য। ছোটকাল থেকে টাকা পয়সা নিয়ে খেলা করছে। জুয়া খেলার নামীদামী প্লেয়ার মানিক। খুব অল্প বয়স থেকেই বাজি ধরতেন। কেবল জুয়াটি নয় মানিক চাচা, মাদক সেবন করা, নারী কেলেঙ্কারি ও অবৈধ যতো লেনদেন আমাদের সমাজে হচ্ছে তা মানিক চাচার অবদান। যেখানে খারাপ কিছু ঘটছে সেখানে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে মানিক চাচার হাত আছে। এটা সবাই জানে বলে তার অপকর্মে মানুষ বিরক্ত হয় বেশি তবে অবাক হয় কম। অবাক কের হবে? এ তো নিয়মিত করছে এসব।
তাওকির আহমদ মানিক। লোকটা দেখতে তেমন ভয়ংকর নয়। শারীরিক গঠন, কথা বলার ভঙ্গি সবকিছু গোবেচারা টাইপের হলেও তার প্রত্যেকটা কাজ ভয়ংকর। মানিক চাচা কেন এ পথে? তার ইতিহাস জানতে চেয়েছিলাম, চাচা সেদিন বলেছিলেন, তার বাবা নাকি খুব বেশি আদর করতেন। আদর সোহাগের নিচে চাপা পড়েছিল শাসন। অতি অল্প বয়স থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে খেলা করছে, যেখানে যতো ইচ্ছে খরচ করেছে। সেখান থেকে শুরু করেন জুয়া। জুয়া খেলায় হেরে গেলে মনকে শান্ত করা কিংবা টেনশন মুক্ত থাকার ঔষধ হিসেবে ধরছে মাদক। আর এসব মাদক আর জুয়ার টাকা জোগাড় করতে শুরু করছে অবৈধ ব্যবসা। যা আজ অবধি চলছে।
বশির চাচা মানিক চাচার সম্পূর্ণ বিপরীত। তার বাবা কৃষক। পরের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করতেন। সেই পেশা ধরছেন বশির চাচাও। পরের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেন। মাঝেমধ্যে অন্যের খেত-খামারে কাজ করে বাড়তি আয় করেন। সহায়সম্পত্তি বলতে ভিটেমাটি ছাড়া কিছুই নাই। গত পাঁচ বছর থেকে টাকা-পয়সা মোটামুটি ইনকাম করছেন। ইটের দালান তুলে টিনের ছাউনি দিয়ে চার রুমের ঘর তুলেছেন। দুই বছর অাগে বিয়ে করছেন। স্ত্রী খুবই রূপবতী। মাধ্যমিক পাশ করা শিক্ষিতও। মাস কয়েক অাগে ফুটফুটে একটি কন্যা সন্তানও জন্ম নিয়েছে তাদের সংসারে। মা, স্ত্রী ও কন্যা সন্তান নিয়ে সুখের সংসার করছেন বশির চাচা। কিন্তু হঠাৎ পাল্টে গেলো তার জীবন। পতিত হলো মানিকদের কুণ্ডলে।
সেদিন বশির চাচার স্ত্রী, রিনা আক্তার আমার মায়ের কাছে এসে হু হু করে কান্না শুরু করে দিলেন। বলে, "ভাবি আপনার দেবরের অবস্থা দেখছেন? কি খেলা নাকি শুরু করছে। কোথায় কাজ কোথায় খাবার কিছুর ঠিক-ঠিকানা নাই। কোথায় খায় সেটাও জানিনা, আমরা কি খাই তাও খবর নেয় না। বাড়িতে খাবার নাই, চাল নাই এসবে তার কোনো খবর নাই। গভীর রাতে বাড়ি ফেরে। যতোক্ষণ বাড়িতে থাকে ততোক্ষণ মাথা গরম। কিছু বললেই গালিগালাজ করে। বড় বড় গলায় কার সাথে ফোনে কথা বলে। পাঁচ হাজার, সাত হাজার টাকায় নাকি খেলা নেয়। আচ্ছা ভাবি সে এমন কেন হয়ে গেছে?" আমার কি হবে এখন? এই বলে আবার কান্না শুরু করে।
মা তাকে সান্ত্বনা দেন। দুঃশ্চিন্তা না করার পরামর্শ দেন। মা চাচাকে বুঝাবেন এবং বশির চাচা অচিরে ফিরে সবেন এমন শ্বাস দিয়ে কান্না থামান। যাওয়ার সময় পাঁচ কেজি চালও তুলে দেন চাচির হাতে।
ঠিক এক সপ্তাহ পরের ঘটনা। খেলা ছিল 'রংপুর রাইডার্স' বনাম 'চিটাগাং ভাইকিংস'। এটা মাঠের খেলা। যা সারাবিশ্ব দেখবে। কিন্তু আমাদের এলাকার খলিল মিয়ার দোকানে যে খেলা ছিল তা হলো 'মানিক চাচা' বনাম 'বশির চাচা'। পাঁচ হাজার করে বাজি। টাকা জামানতের দায়িত্ব পেয়েছেন বিশ্বস্ত লোক খলিল মিয়া। বশির চাচা খেলবেন রংপুর রাইডার্স' হয়ে আর মানিক চাচা 'চিটাগাং ভাইকিংস'। খেলা যথা সময়ে শুরু হলো। লোকে লোকারণ্য খলিলের দোকান। ভালো ব্যবসা চলছে। হৈ হুল্লাড় চলছে। সাঙ্গপাঙ্গদের কেউ 'বশির ভাই' আর কেউ 'মানিক ভাই' বলে স্লোগান দিচ্ছে। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত পুরো স্টেশন। পুরো দর্শক দু'দলে বিভক্ত। যারা 'চিটাগাং ভাইকিংস'র সমর্থক তারা মানিকের দলে আর যারা 'রংপুর রাইডার্স'র সমর্থক তারা বশিরের দলে। যে যার পক্ষ হয়ে স্লোগান দিচ্ছে তাদের জন্য চা নাস্তা ফ্রি ।
খেলা প্রায় শেষের দিকে। মানিক চাচা হেরে যাচ্ছেন। বশির চাচার রংপুর বশির চাচাকে জয়ের রাইডার্সে তুলে নিচ্ছেন। মানিক চাচার মাথা খারাপের মতো অবস্থা। পাঁচ হাজার টাকা কোনো বিষয় না, কিন্তু একটা ইজ্জত আছে না! টেংরা ধরণেন খেলোয়াড় বশিরের কাছে হেরে যাবে? চারদিকে এতো লোক। এতো সমর্থক, সবার সামনে নিজের পরাজয়! কিভাবে মেনে নিবে? সবাই স্লোগান দিচ্ছে বশিরের নামে। এমন অপমান থেকে বাঁচতে দোকানের পেছনে গেল এক পেগ গিলে টেনশন দূর করবে বলে। টেনশনের এসব ঔষধ তার কাছে প্রায় সময় থাকে। এক পেগ খেতে গিয়ে লোভ সামলাতে পারেনি। ডাবল খেয়ে পেলছিল। আবার ফিরে এসে বসে।
ততোক্ষণে তার মাথা ধরে যায়। মাতলামি শুরু করে দেন। এদিকে খেলাও শেষ। 'রংপুর রাইডার্স' জিতে গেছে এবং 'চিটাগাং ভাইকিংস'হেরে গেছে। মানিক চাচার মাতলামি দেখে সবাই হু হু করে হেসে উঠে। হেসে উঠে বশির চাচাও। কেবল হাসেনি, মুখ ফসকে একটি অস্বাভাবিক বাক্যও বলে ফেলে। মানিক চাচার মাথা ধরে যায়, মাতলামি আরো বেড়ে যায়। কথা কাটাকাটি হয় দু'জনের মধ্যে। কথা কাটাকাটি চলতে চলতে তা হাতাহাতিতে রূপ নেয়। তারপর চিল্লায় বলে, "তোর মতো একজন ছোট লোকের মুখে এমন বড় কথা!" দাঁড়া বলে দোকানের পেছন থেকে একটি লোহা নিয়ে আসে। তারপর আঘাত করে বশিরের মাথায়। রক্তের বন্যা বয়ে যায় খলিলের দোকানে। সবাই হৈচৈ শুরু করে দেয়। পাড়াপড়শিরা এসে বশিরকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে বশির। এদিকে মানিক উধাও। হয়তো কিছুদিন আত্মগোপনে থাকবে। তারপর থানা কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে আসবে। টাকা থাকলে জামিন নেয়া সহজ। জামিনের পর সদম্ভে ঘুরেবেড়াবে। এমনভাবে ঘুরেবেড়াবে যেন কিছুই হয়নি। বশিরের কি হবে? সে তো চলে যাবে। আর বেঁচে থাকলেও তার পরিবার বাঁচবে না। পরিবারের খাবার আসবে কোত্থেকে? স্ত্রী রিনা বারবার মুর্ছা যাচ্ছিলো। কোলের অবুঝ শিশুটি বাবার সাদা ব্যান্ডেজ মোড়ানো মাথার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। বশিরের হুশ নাই। হুশ নাই মানিকদের মতো জুয়াটিদেরও। তাদের খেলা থেমে নাই। চলছে। চলবে।
পুলিশ এসে খলিল মিয়ার দোকান বন্ধ করে দেয়। খলিল মিয়াকেও মামলার আসামি করা হয়। দুই সপ্তাহ যাবৎ খলিলের দোকান বন্ধ। খলিল পালাতক। সাপ্তাহিক কিস্তি দিতে পারছে না বলে, রবিন সাহেব এসে এল.ইডি টেলিভিশন খুলে নিয়ে যান। বশিরের পরিবারে যে অবস্থা, একই অবস্থা খলিলের পরিবারেও। এতোদিন জুয়ার খেলা চলছিল, চলছিল ব্যবসার খেলা। আর এখন অভাবের খেলা, বাঁচা মরার খেলা। খেলার মাঠে চলে পেশাদারি খেলা আর চায়ের দোকানে চলে নেশার খেলা। সেই নেশার খেলা আমাদের সমাজকে কলুষিত করছে। সুখের পরিবারকে ছন্নছাড়া করছে। সতীসাধ্বী স্ত্রীদের পথে বের করে। তছনছ করে মাটির সাথে মিশে দিয়েছে সুখকে। এই তো নেশার খেলা। যে খেলায় পতিত হয়েছে বশির চাচা!
বিপিএল চলছে, চলবে। চলবে বিশ্বমানের আরো অনেক খেলা। সূর্য একদিকে উঠছে অন্যদিকে ডুবছে। এটার গতি ঠিক থাকবে। মানিকদের অপকর্ম চলছে, চলবে। কিন্তু বশির চাচা কি আর স্বরূপে ফিরে আসবে?
ফিরে আসবে কি খলিলের ব্যবসা?
No comments